সংকটের মাঝেও আনন্দে ঈদ উদযাপন রোহিঙ্গাদের

সংকটের মাঝেও আনন্দে ঈদ উদযাপন রোহিঙ্গাদের
উদাস চোখের দুঃস্মৃতি নিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন লাখো রোহিঙ্গারা। ঈদের নামাজ শেষে মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং স্বদেশে মর্যাদার সঙ্গে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন তারা। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ঈদুল ফিতরে উৎসবের আমেজ কিছুটা বেশি ছিল কক্সবাজারের উখিয়া—টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে। আর শিশুরা সেজেগুজে, নতুন জামা—কাপড় পরে ক্যাম্পের রাস্তায় হৈ—হুল্লোড় আর আনন্দে মেতে উঠে।

উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প—৮; চারপাশে রোহিঙ্গাদের বসতি, ঠিক বসতির মাঝখানে খোলা মাঠ। এই খোলা মাঠে করা হয়েছে ঈদের নামাজ আদায়ের প্যান্ডেল। বাঁশ আর রঙিন কাগজ। সুতার সঙ্গে মাঝে মাঝে টাঙানো হয়েছে ফুল আর বেলুন। এভাবে সেজেছে  ক্যাম্পের প্রতিটি ঈদ নামাজ আদায়ের ময়দান।
বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) সকাল ৮ টায় ঈদের নামাজ, তাই প্রতিটি বসতি থেকে দলে দলে ঈদের নামাজ আদায়ে ময়দানে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। সবার গায়ে নতুন জামা। ঠিক ৮ টায় একযোগে ক্যাম্পে শুরু হয় ঈদ জামাত। ছোট—বড় সবাই কাঁদে কাঁদ মিলিয়ে আদায় করেন ঈদের নামাজ।
নামাজ শেষে শুরু হয় মোনাজাত, চলে দীর্ঘক্ষণ। আর মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং স্বদেশে মর্যাদার সঙ্গে নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও ফিলিস্তিন মুসলমানদের রক্ষায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন রোহিঙ্গারা।

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা বশর বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে ঈদের নামাজ আদায় করতে পেরেছি তার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। তবে আমরা সব চেয়ে বেশি খুশি হতাম যদি নিজ দেশ মিয়ানমারে ঈদ উদযাপন করতে পারলে? আমাদের এখন একমাত্র স্বপ্ন মিয়ানমারে ঈদের নামাজ আদায় করা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসে আহ্বান জানাচ্ছি।
লম্বাশিয়া ক্যাম্প—১ এর বাসিন্দা হামিদ বলেন, আমরা দেশে যেভাবে ঈদ করতাম, এখানে সেভাবে ঈদ করতে পারি না। কারণ সবকিছুর পরও এটা আমাদের দেশ না। এই জন্য শিশুদের মাঝে আনন্দ দেখা গেলেও আমাদের কোনও আনন্দ নেই। তাই ঈদের নামাজ শেষে মোনাজাতে বিশেষ করে নিজ ভূমিতে অধিকার নিয়ে ফিরে যেতে পারবো সেই প্রার্থনাও করা হয়েছে।
কুতুপালং ক্যাম্প—ডি—৫ এর বাসিন্দা বাদশা মিয়া বলেন, ঈদের সময় গ্রামের লোকজন ঘরে এসে সেমাই ও চালের রুটির সঙ্গে রান্না করা গরুর মাংস খেয়েছে। আর এখন সেমাইর জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। এটা বড়ই লজ্জার ব্যাপার। প্রিয় জন্মভূমিতে সত্যিই কি ফেরা হবে এমন সংশয় এখনো গভীর রোহিঙ্গাদের ভেতরে। এই দেশে বোঝা হয়ে আর কত দিন থাকতে হবে? জানি না, আবার কখন ফিরে পাবো হারানো ঈদের সুখের দিনগুলো।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ক্যাম্প ঘুরে সরেজমিনে দেখা যায়, ক্যাম্পগুলোর প্রবেশদ্বারে বেলুন আর ঈদ মোবারক লেখা ব্যানারে গেইট বানিয়ে রঙ—বেরঙের কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে। এসব ক্যাম্পে শিশুরা সকাল থেকেই সেজেগুজে, নতুন জামা—কাপড় পরে ক্যাম্পের রাস্তায় হৈ—হুল্লোড় আর আনন্দে মেতে উঠেছে। তবে শিশুরা প্লাস্টিকের খেলনা বন্দুক হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি ও নাগরদোলায় চড়ে আনন্দ উপভোগ করছে। আবার অনেকে নতুন জামা, গেঞ্জি, মাথায় টুপি ও চশমা পরে দল বেঁধে আনন্দে মেতে উঠছে।
কুতুপালং ক্যাম্প ৫ এ রোহিঙ্গা শিশু রাবেয়া (১০) ও কুলছুমা (১২) বলেন, আজ সারাদিন ঘুরে বেড়াবে। প্রচণ্ড রোদের কারণে বেশি আইসক্রিম আর চকলেট খাব, আর দোলনা চরব।
উখিয়াস্থ ৮ এপিবিএনের অধিনায়ক মো. আমির জাফর বলেন, ‘ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা ঈদ উদযাপনে মেতে উঠেছেন। তবে কেউ যাতে ক্যাম্পের বাইরে না যান, সেজন্য মাঝিদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ক্যাম্পে যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেদিকেও নজরদারি রাখা হয়েছে।
মো. আমির জাফর আরও বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে সকল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঈদের নামাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঈদে উপলক্ষে নজরদারিতে রাখা হয়েছে ক্যাম্পগুলো।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন—পীড়নের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। সবমিলিয়ে এখন উখিয়া—টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্প ও ভাসানচরে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের বসবাস। তারা এ পর্যন্ত ৭টি ঈদ কাটিয়েছেন ক্যাম্পে।
রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারের ৩২টি ক্যাম্পে অবস্থিত ৩ হাজারের মতো মসজিদ ও নূরানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব মসজিদ ও নূরানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গা শিশুদের হাতে হাতে খেলনা ‘বন্দুক’  :
সারাদেশের ন্যায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে উৎসব ও আনন্দের মধ্যদিয়ে উদযাপিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। তবে ক্যাম্পে সবচেয়ে বেশি আনন্দে মেতে রয়েছেন রোহিঙ্গারা শিশুরা। ক্যাম্পের রাস্তায় রাস্তায় বসেছে অস্থায়ী দোকানপাট। সেখানে বিক্রি হচ্ছে প্লাস্টিকের খেলনার বন্দুক। যার ক্রেতা হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা। এসব খেলনার বন্দুক নিয়ে একে অপরকে ভয় দেখাচ্ছে এবং দৌড়াদৌড়ি করছে।
উখিয়ার প্রতিটি ক্যাম্পে রাস্তার পাশে অস্থায়ীভাবে দোকান বসিয়ে প্লাস্টিকের খেলনা ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের বন্দুক বিক্রি করছে দোকানিরা। এসব দোকানে শিশুদের ভিড় দেখা যায়।
লম্বাশিয়া ক্যাম্প—১ এর রাস্তার পাশে খেলনা বিক্রেতা রফিক বলেন, ‘ঈদের সময় আসলে আমরা কয়েকজন মিলে প্লাস্টিকের বিভিন্ন ধরনের খেলনা বিক্রি করে থাকি। ঈদের তিন দিন এ ব্যবসা চলবে। অন্য বছরের তুলনার এবার বিক্রি বেড়েছে।
এসব খেলনার মধ্যে প্লাস্টিকের বন্দুকই দেখা গেছে বেশি। এ বিষয়ে এই ব্যবসায়ীর ভাষ্য, ‘শিশুরা বন্দুক নিয়ে খেলতে বেশি পছন্দ করে।’
খেলনা বন্দুক দিয়ে খেলাধুলায় শিশুদের মনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের।
রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের কুতুপালংস্থ ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, ক্যাম্পে অস্থায়ী দোকান বসানো সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু রাস্তার পাশে এভাবে অস্থায়ী দোকান বসিয়ে যেভাবে শিশুদের খেলনার বন্দুক বিক্রি করছে এটা কোনোভাবেই উচিত নয়। কারণ এসব শিশুরা মিয়ানমারে অস্ত্রের ব্যবহার দেখেছে, কিভাবে তাদের স্বজনদের হত্যা করা হয়েছে এসব অস্ত্রের মাধ্যমে। এটা শিশুদেরকে সামনের দিনগুলোতে অস্ত্র ব্যবহারে প্রলুব্ধ করবে। যা দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
উখিয়াস্থ ৮ এপিবিএনের অধিনায়ক মো. আমির জাফর বলেন, ক্যাম্পে অস্থায়ী দোকানপাট বসিয়ে শিশুদের খেলনার বন্দুক বিক্রি করা হচ্ছে। এটা শিশুদেরকে অস্ত্রের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। বিশেষটি নজরে এসেছে এবং এখন অস্থায়ী দোকান—পাট যেসবে খেলনার বন্দুক বিক্রি করা হচ্ছে তা উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
চোখের সামনেই স্বদেশ, ঈদেও যাওয়ার উপায় নেই! :
মাস দুয়েক আগেও ঘুমধুম সীমান্তে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে তুমুল লড়াই হয়েছে। গোলাগুলির পাশাপাশি মর্টারশেল, রকেট লঞ্চারের গোলার বিকট শব্দ হয়েছে, যা এপার থেকে শোনা গেছে। অনেক সময় তাদের ছোড়া গোলা ও গুলি বাংলাদেশের ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তে এসে পড়েছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এখনও মাঝে মাঝে ঘুমধুম সীমান্তে গোলাগুলি ও গোলার বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যায় এপারে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্প ও ভাসানচরে গত সাড়ে ৬ বছরের বেশি সময় ধরে আশ্রয়রত রয়েছে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত এসব রোহিঙ্গারা গত ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন—পীড়নের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যাদের গত ১৪ টি ঈদ কেটেছে পরদেশে।
ওপারে এসব রোহিঙ্গাদের গ্রাম—বসতি ছিল। রয়েছে জন্ম, শৈশবের বেড়ে উঠার স্মৃতি। তাই বার বারই এসব রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরতের আকুতি জানিয়ে আসছে। সবশেষ বৃহস্পতিবার ঈদের নামাজ শেষে মোনাজাতে স্বদেশে মর্যাদার সঙ্গে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন আকুতি জানিয়েছেন সকলেই। কিন্তু এসব রোহিঙ্গারা জানেন না কখন বা কবে নাগাদ তারা স্বদেশে ফেরত যেতে পারবেন। বিশেষ করে বর্তমানে মিয়ানমারে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নবাদীর সাথে চলমান গৃহযুদ্ধ এই স্বদেশে প্রত্যাবাসনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে নতুন করে।
তারপরও শেকড়ের টান বা স্বদেশের মাটির দেখার ইচ্ছা যেন মন থেকেই ভুলতে পারেননি তারা। ফলে গত ৩ দিন ধরে এসব রোহিঙ্গাদের ভিড় করতে দেখা গেছে ঘুমধুম সীমান্তবর্তী এলাকায়। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তটি দিয়ে মিয়ানমারের অনেক অংশই পরিষ্কার দেখা মিলে। ইতিমধ্যে এই সীমান্ত এলাকায় কক্সবাজার—টেকনাফ সড়ক হয়ে সীমান্ত পর্যন্ত দৃষ্টি নন্দনভাবে তৈরি হয়েছে চার লেনের মৈত্রী সড়ক। একদিনে সড়কের সৌন্দর্য অপর দিকেই মিয়ানমারের ভূমি দেখার ইচ্ছায় এসব রোহিঙ্গারা সড়কটি ভিড় করেছেন।
শুক্রবার (১২ এপ্রিল) বিকালে ওই সড়কে দেখা মিলেছে কয়েক শত রোহিঙ্গাদের। যেখানে স্থানীয় লোকজনের আনাগোনাও ছিল। ফলে ঈদের দ্বিতীয় দিন সড়ক জুড়ে দেখা গেছে মানুষের উপড়ে পড়া ভিড়। ওখানে কথা হয় উখিয়ার ২০ নম্বর ক্যাম্প থেকে আসা বৃদ্ধ আবদুল গফুরের সঙ্গে। 
তিনি জানান, স্বদেশে কখন ফিরতে পারেন জানান না। ওপারে মাটিতেই তার জন্ম। যেখানে কাটিয়েছেন ছোটকাল থেকে যৌবন পর্যন্ত। ফলে ওপারের মাটি—গাছ আর গ্রামের দৃশ্যটি একবার দেখার ইচ্ছা নিয়ে সীমান্তে তার যাওয়া।
রফিকুল ইসলাম নামের এক রোহিঙ্গা যুবক জানান, গত সাড়ে ৬ বছর ধরে নিজের এলাকার বাইরে। এর মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু রোহিঙ্গা চুরি করে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের আসা—যাওয়া করলেও বেশিভাগ আর স্বদেশের মাটি দেখার সুযোগ পাননি। তাই অনেকের মত তিনিও মিয়ানমারের দৃশ্য দেখতে সীমান্ত এলাকায় ঘুরতে আসা।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল আজিজ জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শনিবার পর্যন্ত দফায় দফায় হাজার—হাজার রোহিঙ্গাদের সীমান্তের সড়কটিতে ঘুরতে আসতে দেখা গেছে। এসব রোহিঙ্গারা সীমান্ত এলাকায় এসে মোবাইলে ওপারে ছবি ধারণ, নিজেরা দাঁড়িয়ে ছবি তোলা, ঘুরে—ফিরে আড্ডা দিচ্ছে। পরে আবার ক্যাম্পেও ফিরে যাচ্ছে।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কক্সবাজার

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.