টেকনাফের পাহাড়ে অপহরণের নেপথ্যে তিন কারণ

টেকনাফের পাহাড়ে অপহরণের নেপথ্যে তিন কারণ
মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফের নাফনদী ছোট হয়ে স্থলভাগ হয়ে মিশে গেছে উখিয়া উপজেলা হয়ে বান্দরবনের ঘুমধুম-তুমব্রু এলাকায়। পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। পূর্বে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন আর পশ্চিমের বাহারছড়া ইউনিয়নের পাহাড়ের সরাসারি দূরত্ব সর্বোচ্চ ১০ কিলোমিটার এবং উত্তর হোয়াইক্যং-বাহারছড়া সড়ক আর দক্ষিণের টেকনাফের লেঙ্গুরবিল, লম্বরী, নতুন পল্লান পাড়া, পুরতান পল্লান পাড়া, উপজেলা পরিষদ পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পাহাড়। টেকনাফ হয়ে কক্সবাজার-টেকনাফ আঞ্চলিক সড়কটি দিয়ে উত্তরের যাত্রা দিলে পশ্চিম অংশটি অল্প সংখ্যক বসতি থাকলেও পাহাড় বিরাজমান। যা মিলে গেছে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প। যার দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার এলাকা।

টেকনাফের এই পাহাড়টি ঘিরে তৈরি হয়েছে অপহরণের নানা গল্প। জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ এর মার্চ শুধু মাত্র টেকনাফের পাহাড় কেন্দ্রিক অপহরণের ঘটনা ঘটে ১০১ টি। যার মধ্যে ৫১ জন স্থানীয় এবং ৫০ জন রোহিঙ্গা। যেখানে ৪৬ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন।
এর মধ্যে সর্বশেষ শনিবার দুপুরে অপহৃত টেকনাফের মাদ্রাসা পড়ুয়া শিশু শিক্ষার্থী ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহ (৬) এর কোন খোঁজ মিলেনি। শনিবার দুপুরে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের পূর্ব পানখালী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহ (৬) একই এলাকার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ’র ছেলে। সে পূর্ব পানখালী এলাকার আবু হুরাইরা (রাঃ) মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণীর ছাত্র।
ভূক্তভোগী শিশুর মা নুরজাহান বেগম বলেন, হ্নীলা ইউনিয়নের পূর্ব পানখালী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা রাহমত উল্লাহ, সাদিয়া, আব্দুর রহিম, শাহ আলম ও নুর আলম সহ কয়েকজনের সাথে তাদের পরিবারের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। তারা অপহরণ করে প্রাণনাশ সহ নানাভাবে ক্ষতি সাধন করবে বলে দীর্ঘদিন ধরে হুমকি দিয়ে আসছিল। এর জেরে ধরে তার সন্তানকে অপহরণ করা হয়েছে বলে ধারণা তার। তবে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অপহরণকারিরা কেউ কোনভাবে যোগাযোগ করেনি। ফলে উৎকন্ঠায় রয়েছেন তারা।

টেকনাফ থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গনি জানান, পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। এতে শিশুটিকে এক নারীকে অটোরিকশা তুলে নিতে দেখা গেছে। ঘটনায় সিসিটিভির ফুটেজের ওই নারীসহ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে গেপ্তার এবং শিশুটিকে উদ্ধারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে বলে জানান তিনি।
# কেন এই অপহরণ :
এক বছরে ১০১ টি অপহরণের ঘটনার ধরণ, অপহৃত ব্যক্তি এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্য বলছে, টেকনাফ কেন্দ্রিক অপহরণের নেপথ্যে রয়েছে তিনটি ঘটনা। যার একটি মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা মাদক ইয়াবার লেনদেন। অপর ২ টির মধ্যে সাগর পথে মানবপাচারকারি চক্রের প্রলোভন আর সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য।
মানুষ বন্ধক রেখে মাদক ক্রয় বা মাদকে টাকা উদ্ধার : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত রয়েছে ২৭১ কিলোমিটার। যে সীমান্তবর্তী এলাকায় ৩০ টির বেশি ইয়াবা কারখানা রয়েছে। শুধু মাত্র বাংলাদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে এসব কারখানায় ইয়াবা উৎপাদিত হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন, ইয়াবা কারবারে জড়িত ব্যক্তি এবং অপহৃতদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে আসা এসব ইয়াবা মুলত বাকিতেই পাঠানো হয়। ইয়াবা বিক্রি করে টাকা পরিশোধের শর্তেই আনা হয় এসব মাদক।
সর্বশেষ গত বছরের ২২ ডিসেম্বর র‌্যাব পরিচালিত এক অভিযানে পর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব ১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের ওই সময়ের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এএইচ সাজ্জাদ হোসেনও জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে শতভাগ বাকিতে বাংলাদেশে আনা হয় মাদকের চালান। যে সব মাদক নির্ধারিত এজেন্টের কাছে বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে জমানো হয় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে। ব্যবসায়ীরা যা বিভিন্ন কোম্পানীর বিক্রয়কর্মীদের মাধ্যমে টেকনাফের সংঘবদ্ধ হুন্ডি কারবারিদের কাছে পাঠায়। আর হুন্ডি কারবারিরা টেকনাফের বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রামের খাতুরগঞ্জের ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠিয়ে দেন। যে টাকা ডলারে রূপান্তর হয়ে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া হয়ে পৌঁছে যায় মিয়ানমারের অবস্থানরত মাদকের ডিলারদের কাছে।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ইয়াবা কারবারে টাকা আত্মসাতের চেষ্টা আর যে টাকা উদ্ধারের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক সন্ত্রাসী চক্রের সদস্য এবং ইয়াবা কারবারিরা অপহরণের পর টাকা আদায়কে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অপহরণের যে তথ্য রয়েছে যেখানে কোথাও টেকনাফ পৌরসভার ডেইল পাড়ার শফিক (ছন্মনাম) নামের এক যুবকের কোন তথ্য নেই। তবে এই শফিক অপহরণ হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে। পরিচয় গোপন করার শর্তে এই যুবক জানিয়েছেন, অপহরণ, টাকা প্রদান এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত না করার নেপথ্যের কথা।
মুলত মিয়ানমারের মংডু থেকে টেকনাফের মৌলভীপাড়া সীমান্ত দিয়ে তিনি এনেছিলেন ইয়াবার একটি চালান। যে চালানটি সীমান্তরক্ষী বিজিবি সদস্যরা আটক করেছিল। ফলে তিনি টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হন। মিয়ানমারের ডিলারকে তিনি প্রমাণ দিতে পারেননি ইয়াবার চালান আটকের বিষয়টি।
এ যুবক জানান, ইয়াবা কোথাও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আটক করলে তা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ছবি সহ প্রকাশিত হয়। আর সেই সংবাদের কপি সংগ্রহ করে ডিলারকে দেখাতে হয়। তা না হওয়ায় টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিতে থাকে তাকে। এক পর্যায়ে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রফিক পরিচয়ে এক যুবক তার সাথে যোগাযোগ করে। তাকে প্রস্তাব দেয়া হয় আরেকটি চালান নিয়ে তার বিক্রি করে লাভের টাকা থেকে যেন আগের চালানের টাকা পরিশোধ করা হয়। ওই প্রস্তাবে রাজী হয়ে রফিকের সাথে দেখা করতে গিয়েই তাকে জিম্মি করে রাখা হয়। প্রথমে রোহিঙ্গা ক্যাম্প, পরে পাহাড়ের গহীনের আস্তানা নিয়ে গিয়ে চালানো হয় ধারাবাহিক নির্যাতন। ফলে তার পিতা এবং মালয়েশিয়া থাকা ছোট ভাইয়ের সহযোগিতায় টাকা পরিশোধ করে টানা ৮ দিন পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। বিষয়টি মাদক সংশ্লিষ্ট হওয়ায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করেননি তিনি।
শুধু তা নয়; অপহরণের নেপথ্যে মাদকের লেনদেনের প্রমাণ রয়েছে পুলিশের কাছেও। গত ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে টেকনাফে এসে অপহরণ হয়েছে এমন অভিযোগে একটি মামলা হয়। যেখানে অপহৃত ব্যক্তি সাভার পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মুখার্জিপাড়ার সিরাজুল ইসলামের ছেলে আরিফুল ইসলাম। মামলায় বলা হয়, ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার শুভাঢ্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. সুমনের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে টেকনাফ বেড়াতে যান তিনি। যেখানে অপহৃত হন আরিফুল। পরে পুলিশ টেকনাফ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নিজামুদ্দিনের বাড়ির ভাড়াটে সলিমুল্লাহর বাসার একটা তালাবদ্ধ ঘর থেকে তাকে উদ্ধার করে।
ঘটনা সম্পর্কে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, আরিফুলের বন্ধু সুমন তাকে বন্ধক রেখে ইয়াবার একটি চালান ঢাকায় এনে বিক্রি করেন। বিক্রির পর টাকা পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু ঠিক সময়ে হয়নি। এজন্য আরিফকে আটকে রাখা হয় এবং তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। সঠিক সময়ে ইয়াবার টাকা পেলে বিষয়টি জানাজানি হতো না।
শুধু এটি নয়, মানুষ বন্ধক রেখে ইয়াবার চালান আনা এবং পরে তা অপহরণ মামলার ঘটনা আরও ঘটেছে।
যার একটি গত ২০২৩ সালের ৭ মে নিজেকে বন্ধক রেখে ঢাকায় ইয়াবার চালান পাঠান রাকিব আহমেদ। তিনি মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গিবাড়ী থানার স্বর্ণগ্রামের বাসিন্দা। রাজধানীর একাধিক থানাসহ বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে চারটি মাদক মামলা রয়েছে। কারাগারে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় মেহেদী হাসান নয়ন নামের একজনের। ময়মনসিংহ কারাগার থেকে জামিনের পর নয়ন তাকে আশ্রয় দেন নিজের বাড়িতে। পরে নয়ন রাকিবকে টেকনাফে ফয়সাল নামের একজনের কাছে পাঠান। তাদের মধ্যে কথা হয়, রাকিব জিম্মা হিসেবে থাকলে ইয়াবা দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী রাকিব ৭ মে টেকনাফ যান এবং তাকে জিম্মায় রেখে ইয়াবার একটা চালান ফয়সাল ঢাকা পাঠান। কথা ছিল, ইয়াবা বিক্রি করে মূল্য পরিশোধ করা হবে। কিন্তু ইয়াবা পাওয়ার পর নয়ন আর যোগাযোগ করেননি। ফলে রাকিবকে আটকে রাখা হয়। ১০ মে রাকিব কৌশলে পালিয়ে টেকনাফের একটা গ্রামে আশ্রয় নিলে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মাদক মামলা করা হয়। অন্যদিকে রাকিবকে দিয়ে অপহরণ মামলা করানো হয় নয়ন ও ফয়সালের নামে।
২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা গর্জন বাগান পাহাড়ে অপহরণ হয় ওই এলাকার ৮ জন। অপহৃত ৮ জনই দাবি করে আসছিল পাহাড়ের খালে মাছ ধরতে গিয়ে তারা অপহরণ হন আর ৮ জন ৬ লাখ ৪০ হাজার মুক্তিপণে ফিরেছিলেন ৪ দিন পর ২১ ডিসেম্বর রাতে।
যদিও পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, এই ৮ জনের অপহরণের নেপথ্যে মিলেছে মাদক বেচা-বিক্রির ভিন্ন গল্প। পাহাড়ে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ও বাঙ্গালীরা মিলেই মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে মজুদ করে থাকে। যে ইয়াবা বিক্রির টাকা পরিশোধ না করার জের ধরে এই ৮ জনকে জিন্মি করে আদায় করা হয়েছিল ৮ লাখ টাকা। অপহৃতরা পুলিশের এই তদন্ত মানতে রাজী নন। বলেছেন এসব মিথ্যা। তাদের সন্ত্রাসীরাই অপহরণ করে ছিল।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, ইয়াবা লেনদেনের জের ধরে কিছু ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে। যা অপহরণ, মুক্তিপণ হিসেবে ধরা হলেও পরে তদন্ত করে দেখা গেছে মাদক সংশ্লিষ্ট। টেকনাফ বা উখিয়ায় টাকার বদলে একজনকে বন্ধক রেখে ইয়াবা নিয়ে আসে। ইয়াবা দেওয়ার সময় বলা হয়, বিক্রি করে টাকা সঠিক সময় না দেওয়া হলে জিম্মি রাখা মানুষকে হত্যা করা হবে। এটা ব্যবসার নতুন কৌশল। এটার সাথে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। যাদের আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে।
সাগর পথে মানব পাচার :
কক্সবাজারের সাগর পথে অবৈধভাবে মানবপাচার নতুন কিছু না। উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে মানবপাচারের শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের গহীন পাহাড়ে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী শুরু হয়। এরপর ধরে মানবপাচার বন্ধ হলেও এখন পুরোদমে সক্রিয় রয়েছে সেই মানবপাচার চক্রটি। আর সেই মানবপাচার চক্রের প্রলোভনে শিকার, প্রতারণামুলক জিন্মি করে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা চলছে।
যে ধরণের একটি ঘটনা ঘটেছে গত ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে। ৩ সেপ্টেম্বর বিকালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুরের মো. হোসেন আলীর ছেলে ১৬ বছরের কিশোর মো. হাবিব উল্লাহর সাথে পরিচয় হয় এক টেকনাফের যুবকের। হাবির সৈকতে আনার ফল বিক্রি করতো।
পুলিশের কাছে হাবিবের পিতা হোসেন আলীর দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়েছিল হাবিবকে অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে। একই সময়ে কক্সবাজার সদর থানায় আরও একটি সাধারণ ডায়েরী হয়েছিল। যে ডায়েরীতে চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের স্টেশন পাড়ার আবদুর রহমান উল্লেখ করেছিলেন তার ছেলে রায়হান উদ্দিন (২৮) সৈকতে হকার হিসেবে খাদ্যপণ্য বিক্রি করতো এবং নিখোঁজ রয়েছে।
এই দুইটি ডায়েরীর সূত্র ধরে তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে উদ্ধার করেছিল হাবিব ও রায়হান সহ ৭ জনকে।
ওই দিনই পুলিশ সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজার সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানিয়েছিলেন, গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সদর থানায় লিপিবদ্ধ হওয়া ২ টি সাধারণ ডাইরীর তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারি চক্র কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, মহেশখালী, উখিয়ার কিছু কিশোর ও যুবককে নানা প্রলোভ দেখিয়ে উন্নত জীবনের কথা বলে মালেয়শিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে জিম্মি করে। তাদের প্রথমে টেকনাফের লেঙ্গুর বিল এলাকায় নিয়ে যায়। এরপর সাগর পথে মিয়ানমারের একটি আস্তানায় নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে। ওখানে জিন্মি করার পর নির্যাতন চালিয়ে ফোনে স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপনের টাকা দাবি করে। স্বজনরা নির্যাতনের খবর পেয়ে নানাভাবে পাচারকারীদের বিভিন্ন অংকের টাকাও প্রদান করে। এই টাকা গ্রহণকারি লোকজন, তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ পাচারকারি চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর গ্রেপ্তারদের কৌশলে ব্যবহার করে ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে মিয়ানমার থেকে টেকনাফের সমুদ্র সৈকত এলাকায় ফেরত এনে এই ৭ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। যেখান থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।
যদিও এই ৭ জন সাগর পথে মিয়ানমারের যাত্রাটি একই ট্রলারে ছিল না। এরা পৃথক ট্রলারে, পৃথকভাবে সমুদ্র উপকূল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মিয়ানমারে।
২৫ সেপ্টেম্বর ভোরে শুধু এই ৭ জন ফিরেননি। একই প্রক্রিয়া পৃথকভাবে ফিরেছেন চট্টগ্রামের আরও ৪ কিশোরও। এর মধ্যে ৫৪ দিন পর ঘরে ফিরেছিল চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানা অধিন আব্দুর শুক্কুরের ছেলে আনসারুল করিম। কক্সবাজারে মাছ ধরার ট্রলারে চাকরি দেওয়ার নামে গত ২ আগস্ট বাকলিয়া থেকে আনসারুল করিমকে নিয়ে যায় আব্দুল করিম নামের এক যুবক। পিতা আব্দুর শুক্কুরকে জানানো হয়েছিল তারা মোট ৪ জন কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। এরপর আর কোন খোঁজ মিলেনি। ৪ আগস্ট শুক্কুরের স্ত্রীর ফোন নম্বরে জানানো হয় ৪ কিশোরকে অপহরণ করা হয়েছে। ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হবে, না দিলে হত্যা করা হবে। বিষয়টি নিয়ে ১১ আগস্ট বাকলিয়া থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলার সূত্র ধরে পুলিশ আবদুল করিম সহ ৫  রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার মেহেদী হাসান ওই কিশোরদের অপহরণের কথা আদালতে স্বীকারও করে। এক পর্যায়ে পুলিশ জানতে পারে, অপহৃত কিশোরদের অবস্থান মিয়ানমারে। তাদের উদ্ধারে পুলিশ অপহরণকারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে চার কিশোরকে ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে টেকনাফের লম্বরীঘাট এলাকায় রেখে যাওয়া হয়। পরে পুলিশ গিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে।
 
বাকলিয়া থানার ওসি আব্দুর রহিম জানান, চার কিশোরকে মাছ ধরার ট্রলারে চাকরি দেয়ার কথা বলে তিনি টেকনাফে নিয়ে যান। সেখানে তাদের তুলে দেয়া হয় হারুনের হাত। হারুন তাদের পৌঁছে দেন সাইফুল ইসলাম সাবু নামে একজনের কাছে। সাবু এবং তার চক্রের কয়েকজন মিলে চার কিশোরকে সমুদ্র পথে পাচার করে দেয় মিয়ানমারের বুচিদং এলাকার জোবায়েরের কাছে। জোবায়েরই ওই কিশোরদের অভিভাবকদের কাছে কল করে মুক্তিপণ চেয়েছিল। যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারাও মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক আসিফ মুনীর জানান, মুলত মানবপাচারে শক্তিশালি একটি চক্র জড়িত। যারা ট্রলারে মানুষ তুলে দিয়ে নগদ অর্থ পান। যাদের মিয়ানমার বা থাইল্যান্ডে জিন্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে থাকা। এর জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো এবং আ লিক রাষ্ট্রের সাথে আলোচনা জড়িত। একই সঙ্গে মানবপাচারের ঘটনায় ২০১৫ সালে যে সব মামলা হয়ে তার অগ্রগতি কি, বিচার নিশ্চিত করা জরুরী হয়ে উঠেছে। না হয় ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
কক্সবাজার আদালত ও কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য মতে, কক্সবাজার বিভিন্ন থানা ও আদালতে ৬৫০টির বেশি মানব পাচারের মামলা রয়েছে। এসব মামলায় আসামি এক হাজারের বেশি। এর মধ্যে বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারাধীন মামলা ৩৩০টি, ট্রাইব্যুনাল-২ এ মামলা ৫৮টি এবং ট্রাইব্যুনাল-৩ এ বিচারাধীন ২৬০টি। বাকি ১৬টি মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালের পর থেকে হওয়া এসব মামলার একটিরও বিচার হয়নি।
কক্সবাজার জেলা দায়েরা ও জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, মানব পাচার জঘন্য একটি অপরাধ। কিন্তু বিচারক সংকট ও নানা কারণে এখন পর্যন্ত একটি মামলার বিচারও শেষ করতে পারিনি আমরা। তবে আদালত মানব পাচার মামলাগুলো দ্রুত বিচার শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন বিচারক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
টার্গেট অপহরণে মুক্তিপণ :
এসব অপহরণের পাশাপাশি টার্গেট অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে থাকে একই চক্রটি। যারা পাহাড়ের আশে-পাশের কৃষক সহ সাধারণ মানুষ। নানা কৌশলে মানুষকে পাহাড়ের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে এসব অপহরণের ঘটনা সংগঠিত করে।
যে অপহরণের গল্প প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালের ২৯ জুন। ওই দিনে হোয়াইক্যং-বাহারছড়া সড়ক থেকে অপহরণ করা হয় বাহারছড়ার উত্তর শিলখালী এলাকার মৃত ছালেহ আহমেদের ছেলে সিএনজি চালক মোহাম্মদ করিমকে। এর পর ফোনে মুক্তিপণের টাকা দাবি করা হয়। পরিরারের লোকজন ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণও দেন। কিন্তু ছেড়ে দেয়া হয়নি। পরে ১২ আগস্ট বনবিভাগ কর্তৃক ঝোপঝাড় পরিস্কার করার সময় পরিচ্ছন্নতা কর্মীর একটি মাথার খুলি ও কঙ্কাল দেখতে পায়। মরদেহের পরিহিত কাপড়, বেল্ট দেখে এটি করিমের মরদেহ বলে শনাক্ত করা হয়।
বাহারছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আবুল মঞ্জুর জানান, এই পাহাড়টি যৌথ বাহিনী অভিযান করে সশস্ত্র সন্ত্রাসী আটক কঠিন কোন কাজ না। রহস্যজনক কারণে এটা হচ্ছে না। আর এ অপহরণের ঘটনায় রোহিঙ্গার সাথে মিশে গেছে স্থানীয়রাও। তাদের শনাক্তের দাবি জানান তিনি।
 
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কক্সবাজার

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.