নাগরিকদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করলো মিয়ানমার

নাগরিকদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করলো মিয়ানমার
মিয়ানমারে প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করেছে দেশটির জান্তা সরকার। এমন একটি সময় এই ঘোষণা আসলো যখন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে দেশটির সামরিক বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বেসামরিক সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। কিন্তু গত মাস থেকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং অভ্যুত্থানবিরোধী যোদ্ধাদের সাথে একের পর এক যুদ্ধে তাদেরকে পরাজিত হতে দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় শনিবার দেশের প্রাপ্ত বয়স্ক তরুণ-তরুণীদের সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক ঘোষণা করলো জান্তা সরকার।
ঘোষণা অনুযায়ী, এখন থেকে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সকল পুরুষকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে অন্তত দুই বছর কাজ করতে হবে। আর নারীদের মধ্যে যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৭ বছরেরে মধ্যে, তাদেরকেও একই মেয়াদে সামরিক বাহিনীতে চাকরি করতে হবে। এর বিষয়ে আর কোন বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি জান্তা সরকার। তবে এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে যে, দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে “প্রয়োজনীয় উপবিধি, প্রক্রিয়া, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি এবং নির্দেশাবলী প্রকাশ করবে”।
আইন না মানলে জেল
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছে একের পর এক অপমানজনক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। ২০২৩ সালের শেষের দিকে মিয়ানমারের তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিলে হামলা চালিয়ে শান রাজ্যের সীমান্ত ক্রসিং এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো দখল করে নেয়। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই রাজ্যটি মিয়ানমারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দিয়েই সড়কপথে চীনের সাথে বেশির ভাগ বাণিজ্য সংঘঠিত হয়ে থাকে।
গত মাসে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) জানিয়েছে যে, তারা মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পালেতোয়া এবং মিওয়াতে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত শেষ সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

এর আগে, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়ে সতর্ক করেছিলেন যে, বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে দেশটি ভেঙে যেতে পারে। দেশের সামরিক বাহিনীতে নাগরিকদের বাধ্যতামূলক যোগদানের বিধান রেখে ২০১০ সালে মিয়ানমারে একটি আইন চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এতদিন সেটি কার্যকর করা হয়নি।
আইনটিতে দুই বছরের জন্য নাগরিকদের সামরিক বাহিনীতে চাকরি করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে আইনে এটাও বলা হয়েছে যে, জরুরি অবস্থায় সামরিক বাহিনীতে চাকরির এই মেয়াদ পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। নাগরিকদের কেউ এই আইন না মেনে চাইলে একই মেয়াদে জেল খাটতে পারে বলেও আইনে বলা হয়েছে।
২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল জান্তা সরকার। সম্প্রতি সেই জরুরি অবস্থা আরও ছয় মাসের জন্য বাড়ানো হয়েছে।
২০১১ সালের গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়ার আগে মিয়ানমার প্রায় ৫০ বছর নিপীড়নমূলক সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। এরপর একটি গণতান্ত্রিক সরকার দেশটির ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি একটি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির সামরিক বাহিনী পুনরায় ক্ষমতা দখল করে নেয়।
এরপর থেকেই মিয়ানমারে যুদ্ধ ও সহিংসতায় চলে আসছে। এতে দেশটির হাজার হাজার নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে এবং দল লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
কী হচ্ছে মিয়ানমারে
স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সামরিক বাহিনীর সংঘাত চলমান থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে সেই সংকট সামাল দিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে দেশটির জান্তা বা সামরিক শাসকরা।
অক্টোবরে হামলা শুরু হবার পর থেকে হাজার হাজার সৈন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দখলে থাকা অনেক শহর ও এলাকা বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে।
মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের একটি দল যারা 'স্পেশাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার' নামে পরিচিত, তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির জান্তা সরকারের 'পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ' রয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ ভূখণ্ডের উপর, ২৩ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দখলে রয়েছে ৫২ শতাংশের মতো ভূখণ্ড।
থাইল্যান্ড ভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম ইরাবতীতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশে ৩৩টি শহরের দখল হারিয়েছে। এর মধ্যে চিন, সাকাই, কিয়াং প্রদেশ এবং উত্তরাঞ্চলের শান এবং শিন রাজ্য উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মিরা দখলে নিয়েছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। জানুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন ও আরাকান রাজ্যেও যুদ্ধ-পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
দু’পক্ষের সংঘাত এতটাই তীব্র আকার নেয় যে চলতি বছরের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি থেকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে। এর আগে শত শত সৈন্য সীমান্ত দিয়ে চীন ও ভারতে পালিয়েছে। যুদ্ধ না করেই হাজার হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে।
অভ্যুত্থানের পর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত জান্তা সরকার ত্রিশ হাজারের মতো সেনা হারিয়েছে। যেখানে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে সেনার সংখ্যা মাত্র দেড় লাখ।
সামরিক বাহিনী প্রতিদিনই পরাজয়ের মুখে পড়ছে এবং তারা দখল হয়ে যাওয়া ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতেও ব্যর্থ হচ্ছে। এমন অবস্থায় সামরিক বাহিনী দ্রুত জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারাচ্ছে। এই অবস্থায় মিয়ানমার সরকারের পক্ষে নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজটি বেশ কঠিন।
 
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

আন্তর্জাতিক

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.