রাসুলে কারীম স. এর শাশ্বত আদর্শই মানবজাতির মুক্তির একমাত্র পথ : হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর

রাসুলে কারীম স. এর শাশ্বত আদর্শই মানবজাতির মুক্তির একমাত্র পথ : হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর
ইসলামের ইতিহাসে রবিউল আউয়াল অত্যন্ত তাৎপর্যবহ ঐতিহাসিক একটি মাস। শিরক, পৌত্তলিকতা-কুসংস্কার ও অন্যায়-অত্যাচারে  পুরো পৃথিবী ছিল গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন। মানবতা, শান্তি ও নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিলো না। এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে ৫৭০ ঈসায়ী মোতাবেক রবিউল আউয়াল মাসে আল্লাহ তা'আলা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী- রাসুল হিসেবে  হযরত মুহাম্মদ স. কে প্রেরণ করেন।  তিনি হেদায়তের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে মানবজাতিকে আহবান জানান শান্তি ও সম্প্রীতির দিকে, সমবেত করেন আল্লাহর একত্ববাদ ও স্বীয় রেসালতের পতাকাতলে। ফলে রাসুলে কারীম স. এর শ্রেষ্ঠতম জীবনাদর্শে উদ্ভাসিত হয় সমগ্র জগৎবাসী। সুন্নাতে নবভীর আলোয় আলোকিত হয়ে গড়ে উঠে সাহাবায়েকেরাম র.  নামক জান্নাতী কাফেলা। আর যারা রাসুলে কারীম স. এর  সুন্দরতম আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে  নবভী এর আদর্শের বিপরীতে পথ চলেছে,  রাসুলে কারীম স. এর অবমাননা করেছে তারা  হয়েছে গোমরাহী ও ধ্বংসের অতল গহবরে  নিমজ্জিত 
এবং চরম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত। কেবল দুনিয়াতে নয়; পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ পরিণাম।

ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে,  যাঁরা রাসুল স. এর জীবনাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জীবন-যাপন করেছেন তাঁরাই সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহন করেছেন। রাসুলে কারীম স. এর সমুন্নত, শাশ্বত মানবিক, আদর্শিক মিশনের ফলে দলে দলে অমুসলিমেরা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে সমবেত হন। ফলশ্রুতিতে দূরীভূত হয় শিরক, পৌত্তলিকতাসহ যাবতীয় কুসংস্কার। অবসান ঘটে অন্যায়-অত্যাচার, অশান্তি ও অমানবিকতার। স্থাপিত হয় মানবিক মূল্যবোধ ও সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতির প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 
শুধু মুসলিমদের প্রতি নয়; ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথেও  মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. এর প্রতিটি আচরণ সর্বোৎকৃষ্টতম আদর্শ ও  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. মক্কা থেকে মদীনা হিজরত করার পর যে ‘মদীনা সনদ’ প্রণয়ন করেন তা বিশ্ব ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি-সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। এই সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে। যেমন “সনদে স্বাক্ষরকারী সকল গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদীনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সকল ধর্মসম্প্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোন সম্প্রদায় বহিঃশত্রুকর্তৃক আক্রান্ত হলে উক্ত আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোন নাগরিক কোন অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।” (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ ২য় খ-, পৃষ্ঠা ৯৪ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত)। এভাবে ঐতিহাসিক মদীনা সনদের মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ স. ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণরাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেন। মুসলিম ও কুরাইশদের মাঝে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশক’টি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। এতদসত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবী হযরত মুহাম্মদ  স. তা মেনে নেন। কিন্তু প্রতিপক্ষের প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর হুদায়বিয়ার সন্ধিতে হযরত মুহাম্মদ স.-এর নামের সাথে ‘রাসূলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে তো আর আপনার সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ হতো না, আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসূল স. সন্ধির লেখক হযরত আলী র. কে বললেন ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লিখ। এতে হযরত আলী র. অপারগতা প্রকাশ করায়, রাসূল স. নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন। (সীরাতুন্নবী স. ইবনে হিশাম, ৩য় খ-, পৃষ্ঠা-৩৩১ ও সীরাতুল মোস্তফা স. আল্লামা ইদ্রিস কান্দলবী রহ. ২য় খ- পৃষ্ঠা-৩০৯)। ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী  স. বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মহানবী স. বিজিত শত্রুদের প্রতি কোন ধরনের দুর্ব্যবহার করেননি এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণ প্রতিশোধস্পৃহাও প্রকাশ করেননি; বরং দুশমনদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। তিনি কুরাইশদের বলেছেন, ‘হে কুরাইশগণ! আমি তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো বলে তোমরা মনে করো? তারা বললো, ‘আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। আপনি দয়ালু ভাই। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। অতঃপর রাসূল স. বললেন, আমি তোমাদের সাথে সেই কথাই বলছি, যে কথা হযরত ইউসুফ আ. তাঁর ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেন "আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সকলেই মুক্ত।’ (আর-রাহীকুল মাখতুম (উর্দু) পৃষ্ঠা-৬৩৩)। 
রাসুলে কারীম স. এর এরূপ উৎকৃষ্টতম  আদর্শের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও জাগরণ ঘটেছে।   আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, "নিশ্চয় আল্লাহর রাসুল স. এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।" ( সূরা-আহযাব, আয়াত-২১)। আরেক আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, " ( হে নবী) নিশ্চয় আপনি মহান ও সর্বোত্তম চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।" (সূরা-কলম, আয়াত-০৪)।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ স. এর শাশ্বত, চিরন্তন আদর্শ অনুসরণের মধ্যেই আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি  ও মানবতার মুক্তি নিহিত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, "( হে নবী) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, যাতে আল্লাহও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।" (সূরা -আলে ইমরান, আয়াত-৩১)।
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা'আলা আরও ইরশাদ করেন, "রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।" (সূরা-হাশর, আয়াত ০৭)। 
কুরআন ও হাদীসের মর্মবাণী দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে,  আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও ঈমানের পূর্ণতা সাধনের পূর্বশর্ত এবং   রাসুল স. এর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হলো সুন্নাতে নবভী স. এর যথার্থ অনুসরণ করা। নিজেদের জীবানাচারের সাথে সুন্নাতে নবভীর কোন সম্পর্কই না রেখে নবীপ্রেমিক দাবি করাটা অবান্তর।
এ বিষয়ে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন, "যে আমার সুন্নাতকে মুহাব্বত করলো সে আমাকে মুহাব্বত করলো। আর যে আমাকে মুহাব্বত করলো সে জান্নাতে আমার সাথে থাকবে।" আরেক হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসুল স. ইরশাদ করেন, "তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ মু'মিন হতে পারবে না; যে পর্যন্ত তার প্রবৃত্তি আমার আনীত দ্বীনের পরিপূর্ণ অনুসারী হবে না।"  রাসুলে কারীম স. আরও ইরশাদ করেন, "তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ মু'মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষের চেয়ে প্রিয়তর হই।"

তাই সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ শিকার করে হলেও জীবনের সর্বক্ষেত্রে-সর্বাবস্থায় নবীজী স. এর  পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করা এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. এর শাশ্বত আদর্শের আলোয় শান্তিপূর্ণ সমাজবিনির্মাণে নিবেদিত থাকা ঈমানের দাবি। এ দাবি বাস্তবায়িত হলেই  সমাজ হবে আলোকিত।  পথহারা জাতি পাবে আলোর দিশা।  দুনিয়া-আখিরাত উভয় জাহানে মানবজাতি পাবে চিরমুক্তি ও শাশ্বত কল্যাণ। নতুন প্রজন্ম হবে আলোকিত পথের অভিযাত্রী। দিকভ্রান্ত তারুণ্য ফিরে পাবে আলোকিত জীবন।
লেখক-খতীব, 
শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউট জামে মসজিদ, কক্সবাজার। 
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক-
কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

ইসলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.