২৪ একরের মৃত্যুপুরী, বাতাসে উৎকট গন্ধ

২৪ একরের মৃত্যুপুরী, বাতাসে উৎকট গন্ধ
আকাশে কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের ভাটিয়ারি এলাকা থেকে, সঙ্গে তীব্র দুর্গন্ধ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কেশবপুর অংশে বিভিন্ন উদ্ধারকারী সংস্থার সারি সারি গাড়ি।

মহাসড়কের পাশেই কয়েকশ ফুটের একটি রাস্তা চলে গেছে বিএম কনটেইনার ডিপোর মূল ফটক পর্যন্ত। শনিবার রাতে লাগা আগুনে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত জ্বলছিল বেসরকারি ওই ডিপো।
রোববার সকাল সাড়ে ৯টায় ডিপোতে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ডিপোর প্রবেশপথ লাগোয়া অফিস কক্ষে সব জানালার কাচ ভেঙে পড়ে আছে মেঝেতে। তখনো ওই অফিস কক্ষের ডান পাশে রাখা কন্টেইনারগুলোতে আগুন জ্বলছিল।
ফায়ার সার্ভিসের ক্লান্ত একদল কর্মী মূল ফটকের কাছাকাছি এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আগের ১২টি ঘণ্টা তাদের আগুনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। তাতে পুরোপুরি সফল তখনও হতে পারেননি, বরং হারাতে হয়েছে কয়েকজন সহকর্মীকে।      

ফয়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানালেন, চট্টগ্রামের সব ইউনিটের পাশাপাশি খাগড়াছড়ি, কুমিল্লা ও ফেনীর ২৫টি ইউনিট ছুটে এসেছে ডিপোর আগুন নেভাতে।
তখনও মালিকপক্ষের কাউকে ডিপোতে পাননি জানিয়ে তিনি বলেন, “কোথায় কোন পণ্যের কন্টেইনার রেখেছে তা তো আমরা জানি না। এখানে কয়েকটা ড্রামে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড লেখা পেয়েছি।”
একটু এগিয়ে যেতেই দেখা গেল ডিপোর পুরো এলাকা জুড়ে কয়েকশ নীল রঙের প্লাস্টিকের জার ছড়ানো ছিটানো। কিছু জার অক্ষত, কিছু আবার পুড়ে বা গলে গেছে, কিছু জার মাঝ বরাবর ফেটে গেছে। সেগুলোর ওপরে লেখা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড।
২৪ একর আয়তনের ওই কন্টেইনার ডিপোটির মাঝ বরাবর একটি লম্বালম্বি টিন শেড। সামনের কিছু অংশের চালা টিকে থাকলেও পিছনের পুরো চালা উড়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে কাঠামোর বেশিরভাগ।
শেডের ভিতর থেকে ছাই উড়ে এসে বাইরে পড়ছে। শেডের ভেতর কয়েক জায়গায় তখনো জ্বলছে আগুন। শেডের দুপাশে যেসব কন্টেইনারের সারি দিয়ে রাখা ছিল, সেগুলো সবই পুড়েছে।
বিস্ফোরণে কন্টেইনার ভেঙে গিয়ে ধাতব টুকরো ছড়িয়ে আছে সবখানে। কোথাও পড়ে আছে ভাঙা প্লাস্টিকের পাইপ, লোহার টুকরা, বিচ্ছিন্ন হাত-পা, মাথার হেলমেট, লোহার বড় ‍টুকরা। আশেপাশে ছাই হয়ে যাওয়া কাপড়ের কয়েকটি স্তূপ।
দুটি ট্রেইলারের উপর রাখা কন্টেইনারে তখনো আগুন জ্বলতে দেখা গেল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের সাথে তখনো ধ্বংসস্তূপে লাশের সন্ধান করছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউছিয়া কমিটির সদস্যরা।
শেডের শেষ প্রান্ত থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল গল গল করে। সেখানে থাকা কয়েকটি বিধস্ত কন্টেইনারের আশপাশ থেকে একে একে আটটি লাশ উদ্ধার করা হয় বেলা ১০টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে।
ডিপোর ম্যানেজার নুরুল আকতার খান দাবি করলেন, ডিপোতে অগ্নি নির্বাপনের মত ‘প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই ছিল’।
“শুধু হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থেকে আগুন ছড়িয়েছে এমন নয়। তৈরি পোশাকের কন্টেইনারে আগুন লেগে বিভিন্ন পোশাক উড়ে উড়ে বাইরে পড়েছিল। তাতেও আগুন ছড়িয়েছে।”  
ডিপোর পুরো এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ৫০-৬০টি ছোট আকারের ফায়ার এক্সটিংগুইশার পড়ে আছে। আর টিনশেডের বিভিন্ন প্রান্তে চারটি করে বালির ছোট বালতি দেয়ালে রাখা। দেয়ালে আগুন নেভানোর বিষয়ে নির্দেশনাও লেখা আছে।
গাউছিয়া কমিটির শখানেক সদস্য ধ্বংসস্তূপের ভেতর খুঁজছিলেন লাশ, অথবা কেউ যদি বেঁচে গিয়ে থাকে। ধোঁয়া, গন্ধ, আগুনের তাপ, কড়া রোদ আর উড়ে আসা ছাইয়ে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন দ্রুত।
গাউছিয়া কমিটির সদস্য আল আমিন বললেন, “বেশিক্ষণ ভিতরে থাকা কঠিন। কয়েকটা লাশ একদম পুড়ে গেছে। মানুষ যে, সেটাও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
কী ঘটেছিল রাতে?
বিএম ডিপোর পাশেই কেশবপুর গ্রাম। সেই গ্রামের বাসিন্দা মো. রফিক বললেন শনিবার রাতের বিভীষিকার কথা।
“রাতে সাড়ে ১০টার পর হঠাৎ করে বিকট শব্দে আশেপাশের বাড়িঘরসহ সব কিছু কেঁপে উঠল। আওয়াজের পর দেখি বিরাট আগুন।
“শব্দে আমাদের মসজিদের জানালার ফ্রেমসহ ভেঙে পড়ে গেছে। বাসাবাড়ির দরজা-জানালা ভেঙে গেছে।”
বিস্ফোরণের পর আগুনের লেলিহান শিখা দেখে গ্রামের মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় বলে জানান মো. রফিক।
বিএম ডিপোর সীমানা দেয়ালের পাশেই বাজারে একটি দোকান চালান সেলিম। শনিবার রাত ৮টায় দোকান বন্ধ করে তিনি গিয়েছিলেন শীতলপুর। সেখানে তিনি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহীন বলেন, আগুন লাগে সাড়ে ৯টার দিকে। শুরুতে ডিপোর লোকজন নিজেরা আগুন নেভাতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। তখন সেখানে ডিপোর দুই শিফটের কর্মচারী, কাভার্ডভ্যানের চালক-সহকারী, শ্রমিক, সিএন্ডএফের লোকজনসহ হাজার খানেক মানুষ ছিল।
“পরে আগুন নেভাতে না পেরে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন শুরুতে যখন এসেছিল, তাদের সাথে আমি কথাও বলি। পরে তারা ডিপোতে ঢোকে।”
সীমানা দেয়ালের গ্রামের দিকের অংশ থেকে ডিপোর ঘটনা দেখছিলেন জানিয়ে শাহীন বলেন, “যখনই ফায়ার সার্ভিসের লোকজন একটা কন্টেইনারে পানি ছিটাইল, এর পরপর সেটা বিস্ফোরিত হয়ে যায়। তখন যারা কাছাকাছি ছিল, সবাই ছিটকে পড়ে।”
এরপর আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়তে থাকে একের পর এক কন্টেইনারে।
সীতাকুণ্ডের মাদামবিবিরহাট এলাকায় থাকেন স্থানীয় সাংবাদিক মিজানুর রহমান ইউসুফ। ডিপো থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে তার বাড়ি। বিস্ফোরণের শব্দে ওই এলাকাও যেন কেঁপে গিয়েছিল। দূর থেকেও আগুন দেখা যাচ্ছিল রাত ১২টার দিকে।
দুই কিলোমিটার দূরের বার আউলিয়া এলাকায় অন্য একটি কন্টেইনার ডিপোতে ছিলেন কভার্ড ভ্যান চালক মহব্বত হোসেন। বিএম ডিপোতে আগুন লাগার খবর পেয়ে তিনি ছুটে আসেন।
মহব্বত বলেন, “১ তারিখও আমি রাতে এই বিএম ডিপোতে ছিলাম। কাইল রাতে আইসা দেখি আগুন আর আগুন। কেউ কেউ বাইর হইতে পারছে। বাকিরা পারে নাই। যারা বাইরে আসছে তারা কইছে, ভিতরে অনেক মানুষের লাশ পইড়া আছে।”
রোববার সকালে আবার বিএম ডিপোতে এসেছিলেন মহব্বত। তিনি বলেন, “রাতে যে বলছিল ভিতরে লাশ আছে। এখন আইসা দেখি একের পর এক লাশ বাইর হইতাছে।”
ভয়াবহ এ অগ্নি দুর্ঘটনায় রোববার রাত ১১টা পর্যন্ত মোট ৪৯ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। দগ্ধ ও আহত দুই শতাধিক ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে হাসপাতালে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউছিয়া কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও মানবিক সেবা টিমের প্রধান সমন্বয়ক মোছাহেব উদ্দিন বখতেয়ার জানালেন, তাদের স্বেচ্ছাসেবীরা রাতেও কাজ করছেন ডিপোতে। নিখোঁজ কারও খোঁজ যদি মেলে…।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

চট্টগ্রাম


পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.