স্বজন হারানো ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ

স্বজন হারানো ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ
ভয়াল ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহতা।- ফাইল ছবি
আজ স্বজন হারানো ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের এই দিনে শতাব্দীর সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় "ম্যারি এ্যন" তার রুদ্ররোষ নিয়ে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে ঝড়ো গতিতে হামলে পড়ে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার ১৯টি জেলা। তবে এই বিধ্বংসী সাইক্লোনের গতিপথে তোপের মুখে পড়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূল। এই ঘুর্ণিঝড়ে উপকুলীয় ১৯ জেলার ১০২ থানা ও ৯টি পৌরসভায় সরকারী হিসাব মতে নিহত হয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন লোক। নিখোঁজ ছিল ১২ হাজার ১২৫ জন। আহত হয়েছিল ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪ জন। তবে বেসরকারি হিসেবে  এর দ্বিগুণ-তিনগুণ। এমনও রয়েছে যারা পুরো পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছে এ নিষ্ঠুর গোর্কিতে। শুধু জনমানবের ক্ষয়ক্ষতি নয় ভেসে গিয়েছিল শত শত মাছ ধরার ট্রলার, ইঞ্জিন নৌকা। বিধ্বস্ত হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে ও বহির্নোঙ্গরে থাকা বিপুল সংখ্যক দেশী-বিদেশী জাহাজ।

ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিমানবন্দর। লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল বৈদ্যুতিক লাইন। বাতাসের তীব্রতায় বিধ্বস্ত হয়েছিল হাজার হাজার ঘরবাড়ি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যাবসায়িক স্থাপনা। উপড়ে গিয়েছিল গাছ-পালা উপকূলের সবুজ বনানী ও উপকূল রক্ষার ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। তলিয়ে গিয়েছিল লবণের মাঠ, চিংড়ি ঘের, ডান-বাম সহ বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। মারা পড়েছিল লাখ লাখ গবাদি পশু। ব্রীজ কালভার্ট রাস্তাঘাট বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ হয় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। তাইতো তুফানের ৩০ বছর পরও অতীতের স্বজন হারানো বেদনা আর বাস্তুভিটা হারানো স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেনি উপকুলবাসী। ২৯ এপ্রিলের এই দিনটি এলে উপকূলের ঘরে ঘরে এখনো শোনা যায় আপনজন হারানোর কান্নার রোল। উপকূলীয় এলাকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখনো টেকসই বেড়িবাঁধ গড়ে না ওঠায় সম্ভাব্য দুর্যোগ পরিস্থিতিতে জীবনের ভয়ে আঁতকে ওঠেন উপকূলবাসী। তাদের একটাই দাবি আর নয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে সরকারি অর্থের লোপাট। চাই সেনাবাহিনীর মাধ্যমে স্থায়িত্বশীল টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ।
৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের প্রত্যক্ষদর্শী উপকূলীয় এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ শতাব্দী জনগণ জীবনে আর দেখেনি প্রকৃতির রুষ্ট এমন বিভীষিকাময় আচরণ। রাতের বিদঘুটে অন্ধকারে প্রকৃতি যেন তার ইচ্ছেমত প্রতিশোধ নিয়েছিল মানব বসতির উপর।
দীর্ঘ ৯ ঘণ্টার তাণ্ডবে তুলোর মত উড়ে গিয়েছিল মানব বসতি গুলো। বাতাসের তোড়ে সাগরের পাগলা ঢেউয়ে উড়ে আসা পানিতে ভেসে প্রাণ হারায় হাজার হাজার মানুষ। ভোরের আলো ফুটতেই বেঁচে আছে যারা তারা দেখতে পান লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল সর্বত্র। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চল। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই আঘাত। স্বজন হারানোর আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠেছিল চারিদিকের পরিবেশ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এদেশের মানুষ এর আগে আর কখনো হয়নি। পরদিন সারা বিশ্বের মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন ধ্বংশলীলা। আর্তনাদে কেঁপে উঠেছিল বিশ্ব বিবেক।
বাংলাদেশের ইতিহাসে আঘাত হানা ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা বিচারে পৃথিবীর ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল রাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা এ ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৪০ থেকে ২৫০ কিঃমিঃ (ঘণ্টায় ১৫৫ মাইল ) ঘূর্ণিঝড় এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৪২ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরো বেশি। মারা যায় প্রায় ২০ লাখ গবাদিপশু।
গৃহহারা হয় হাজার হাজার পরিবার। ক্ষতি হয়েছিল ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছিল। এই ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
‘ম্যারি এন’ নামের এ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সম্মুখভাগের গতিপথ ছিল কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম উপকূলের দিকে। তাদের বাদ যায়নি নোয়াখালীসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার পুরো উপকূল। এই ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, সদর উপজেলা, মহেশখালী,পেকুয়া ও কুতুবদিয়া এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, কর্ণফুলী, পতেঙ্গা, সীতাকুণ্ড, হাতিয়া, সন্দীপ, নোয়াখালী, ভোলা, হাতিয়া, বরগুনা ও খুলনা-বরিশাল সহ পুরো উপকূলের ১৫ জেলা জুড়েই মানুষ মারা গিয়েছিল। এসব এলাকার কিছু অংশে এখনো বেড়িবাঁধ নেই। তাই আতঙ্কে আছেন লাখ লাখ মানুষ।             
 ৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকার বেড়ীবাঁধসমূহ বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় ফোল্ডার সমূহের ৫৯৬ কিঃমিঃ বেড়িবাঁধের মধ্যে অন্তত ৮ কিঃমিঃ বেড়ীবাঁধ সংস্কার বিহীন অবস্থায় রয়েছে। এসব বেড়িবাঁধের অংশগুলো সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। বেড়িবাঁধের এই ভগ্নদশা গুলো রয়েছে বিশেষ করে মহেশখালীর ধলঘাটা ও মাতারবাড়ীর পশ্চিমাংশে এবং কুতুবদিয়ায়।
এ প্রসঙ্গে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার সাংসদ আলহাজ্ব আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মহেশখালী- কুতুবদিয়া উপজেলার উপকূলীয় জনগণের জানমাল রক্ষার্থে বেড়িবাঁধের যথেষ্ট উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। তবে ধলঘাটা মাতারবাড়ি ও কুতুবদিয়ায় যেসব বেড়িবাঁধ অরক্ষিত রয়েছে আগামীতে সেগুলির নির্মাণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ সরকারের আমলে বেড়িবাঁধের উন্নয়ন সাধিত হয়েছে বলেই আজ দলঘাটাও মাতার-বাড়ীর মত দ্বীপে কয়লা বিদ্যুৎ এর মত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। মহেশখালী দ্বীপে বাস্তবায়নাধীন কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল, এক্সক্লুসিভ টুরিস্ট জোন ও প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং উপকূলে বসবাসকারীদের জানমাল রক্ষার্থে আগামীতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য ভয়াল বিভীষিকাময় স্বজন হারানোর এই দিনে চট্টগ্রাম কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় সরকারি-বেসরকারি ভাবে বিভিন্ন সংগঠন নিহতদের স্মরণে প্রতিবছর স্মৃতিচারণ মূলক দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করলেও গত বছর ও এবছর দেশে করোনা সংক্রমনের পরিস্থিতির কারণে এসব অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কক্সবাজার


পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.