কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে সব শিক্ষা কার্যক্রম। ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেনের অর্থায়নে পরিচালিত এসব কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় দুই লাখ ৩০ হাজারের বেশি শিশু পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে। হঠাৎ একযোগে ১ হাজার ১৭৯ জন স্থানীয় শিক্ষক ছাঁটাই করায় সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
তহবিল সংকটের কথা বললেও শিক্ষকরা অভিযোগ করছেন, এর পেছনে ‘ষড়যন্ত্র’ রয়েছে। আর শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন বলছে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান চায় তারা।
তহবিল সংকটে হঠাৎ একযোগে ১১’শ ৭৯ জন স্থানীয় শিক্ষককে চাকরি থেকে ছাঁটাই করার পর, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে বন্ধ হয়ে গেছে ‘ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেনের’ অর্থায়নে পরিচালিত সব শিক্ষা কার্যক্রম। ফলে পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়েছে দুই লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শিশু। ইউনিসেফ আগেই সতর্ক করেছিল, ক্যাম্পভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মক অর্থ সংকটে রয়েছে। এই সংকটে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়ছে রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যৎ। তাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেলে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অভিভাবক ও রোহিঙ্গা শিক্ষকরা।
ক্যাম্প-৩-এর বাসিন্দা মোহাম্মদ রিয়াজ বলেন, ‘বাচ্চারা ঘর থেকে বের হলে অপহরণের শিকার হতে পারে। আবার দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। স্কুল খোলা থাকলে মা-বাবারা অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকে।’
আরেক বাসিন্দা ফরিদুল আলম বলেন, ‘স্কুল বন্ধ থাকলে বাচ্চারা রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। এতে মা-বাবার দুশ্চিন্তা বাড়বে। স্কুল খোলা থাকলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও কমে।’
রোহিঙ্গা শিক্ষক আসকাব বলেন, ‘শিক্ষা না থাকলে মানুষ একরকম অন্ধ হয়ে যায়। স্কুল বন্ধ থাকলে রোহিঙ্গা শিশুরা চোর-ডাকাত কিংবা পকেটমার হয়ে যেতে পারে।’
আরেক শিক্ষক মোহাম্মদ জোবাইর বলেন, ‘লার্নিং সেন্টারগুলোতে মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুযায়ী জিওগ্রাফি, সাইন্স, বার্মিজ, ইংরেজি পড়ানো হয়। স্কুলগুলোতে শিশুরা তাদের দেশের ইতিহাস ও বাস্তবতা জানার সুযোগ পায়। এখন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পড়েছে।’
বর্তমানে আশ্রয়শিবিরে শিক্ষার উপযোগী শিশু রয়েছে প্রায় ৪ লাখ। এসব শিশুকে পড়াতে নিয়োজিত প্রায় ৮ হাজার শিক্ষকের মধ্যে তিন হাজারই ছিলেন স্থানীয়। তবে অর্থ সংকটের অজুহাতে ছাঁটাই করা হয়েছে ১ হাজার ১৭৯ জন স্থানীয় শিক্ষককে। রোহিঙ্গা শিক্ষকরা বহাল থাকায় তৈরি হয়েছে বৈষম্য ও অসন্তোষ।
ছাঁটাই হওয়া শিক্ষক প্রতিনিধি সাইদুল ইসলাম শামীম বলেন, ‘২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনের পর থেকেই আমাদের ওপর চাপ বাড়ে। পরে হঠাৎ আধাঘণ্টা আগে আমাদের জানানো হয়, আমাদের আর চাকরি নেই। এটা ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়।’
শুধু রোহিঙ্গা নয়, স্থানীয়রাও ক্ষুব্ধ। দ্রুত সমাধান না হলে এলাকায় সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিগত সময়ে বিভিন্ন সংস্থার ফান্ড ব্যাপক হারে কমেছে। অনেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছে। ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেনও তাদের বাজেট সংকোচন করছে। এ কারণে স্থানীয় শিক্ষক ছাঁটাই করা হয়েছে। এতে বৈষম্য হয়েছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। আমরা ইউনিসেফকে বুঝানোর চেষ্টা করছি যেন কোনো পক্ষকে অবহেলা না করা হয়। প্রয়োজনে সবার বেতন কমানো হলেও যেন চাকরিচ্যুতি না করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ। আমরা চেষ্টা করছি উভয় পক্ষকে নিয়ে সমাধানে পৌঁছাতে।’
একদিকে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে স্থানীয় শিক্ষকদের চাকরি হারানোর ক্ষোভ এই দুই দিক থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করছেন, দ্রুত সমাধান না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।