সমুদ্র ভ্রমণে এসে উত্তাল ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দেওয়াটায় স্বাভাবিক। কিন্তু এই উচ্ছ্বাস অনেক সময় জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ঈদের টানা ছুটিতে গত দু’দিনে সাগরে গোসলে নেমে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ভ্রমণে আসা পর্যটকসহ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর গেল ১০ বছরে সমুদ্রে গোসলে নেমে মৃত্যু হয়েছে ৬০ জনের। আর জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে সহস্রাধিক। প্রতিবছরই সমুদ্র সৈকতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুহার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্ট বলছেন, সমুদ্রে গোসলের সময় সতর্ক না থাকা, নির্দেশনা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং সৈকতে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি এর জন্য দায়ী। একই সঙ্গে পর্যটন খাত থেকে হোটেল-মোটেল মালিক এবং সরকার বিপুল টাকা আয় করলেও নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবাই উদাসীন।
১২০ কিলোমিটারের এই সৈকতের মাত্র ৩ কিলোমিটারে (কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত) উদ্ধার তৎপরতা চালানো জন্য বেসরকারি একটি সংস্থার ২৭ জন কর্মী রয়েছেন। অবশিষ্ট ১১৭ কিলোমিটার সৈকত অরক্ষিত পড়ে থাকছে। বিশেষ করে টেকনাফ, বাহারছড়া, পাটোয়ারটেক, ইনানী, হিমছড়ি, দরিয়ানগর, কলাতলী, শৈবাল ও মাদ্রাসা পয়েন্টের সৈকতে কেউ গোসলে নেমে নিখোঁজ হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর কেউ নেই।
তবে লাইফ গার্ড সংস্থা বলছে, সমুদ্রে গোসলের সময় দুর্ঘটনা এড়িয়ে সতর্ক থাকতে করণীয় সম্পর্কে জানতে হবে।
'সমুদ্রে গোসলের নামার সময় লাইফ গার্ডের নির্দেশনা উপেক্ষা'
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে নিষেধ সত্ত্বেও পর্যটকদের সমুদ্রের পানিতে নামা। গোসলের জন্য নির্ধারিত জায়গা থাকলেও অনেকে ঝুঁকি নিয়ে আরও গভীরে চলে যান। লাইফ গার্ড কর্মীদের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পরেও দর্শনার্থীরা তা উপেক্ষা করেন। সৈকতের প্রতিটি পয়েন্টেই এই বিড়ম্বনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমনকি বিপজ্জনক সময়গুলোতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার সময়েও কিছু পর্যটকদের সামাল দিতে যেয়ে রীতিমত ঝামেলার সম্মুখীন হন লাইফ গার্ড কর্মীরা।
ফলশ্রুতিতে একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলেছে। এই অসতর্কতা ও নিরাপত্তাজনিত নির্দেশনা অমান্য করাই মূলত দায়ী প্রতি বছর মৃত্যুর ঘটনাগুলোর জন্য এমনটা বলছেন লাইফ গার্ড সংস্থা।
'সংকেত সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব'
সমুদ্রে নামার আগে থেকেই জোয়ার-ভাটার তথ্যটা সবার জেনে নেওয়া উচিত। সৈকত প্রশাসন প্রতিটি বৈরী আবহাওয়ায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে সতর্ক সংকেত ও সংখ্যা দিয়ে বিপদের মাত্রা সম্পর্কে অবহিত করা হয় জনসাধারণকে।
কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই সংকেত বা সংখ্যার অর্থ অনেকেই জানেন না। কোন রঙের পতাকা কি অর্থ বহন করছে সে বিষয়ে অনেকেরই কোনো স্পষ্ট জ্ঞান নেই। সৈকতের কোন কোন প্রবেশদ্বারগুলোতে সমুদ্রস্নানের নির্দেশনা থাকলেও তা একবারের জন্য পড়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেন না কেউ।
'লাল-হলুদ এবং লাল পতাকা ব্যাপারে অজানা'
সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে লাইফ গার্ড কর্মীরা লাল-হলুদ এবং লাল পতাকা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলো কখন ও কোথায় সমুদ্রের পানিতে যাওয়া নিরাপদ তার নির্দেশনা বহন করে। লাল রঙের পতাকা মানে সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না। আর লাল-হলুদ পতাকার অর্থ সমুদ্রে গোসল করা নিরাপদ। গোসলের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে লাল-হলুদ পতাকা লাগানো জায়গাগুলোতে থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই লাল পতাকা লাগানো জায়গা অতিক্রম করা যাবে না।
'রিপ কারেন্ট থেকে সাবধান'
রিপ কারেন্ট হল ঢেউয়ের শক্তিশালী অবস্থা যখন তা সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। এই ঢেউ যে কোনো দক্ষ সাঁতারুকেও খড়কুটোর মতো দ্রুত সমুদ্রের গভীরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এ সময় কোনভাবেই সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না। যথাসম্ভব আগে থেকেই লাইফ গার্ড কর্মীদের কাছ থেকে রিপ কারেন্টের সময়ের ব্যাপারে জেনে নিতে হবে।
'সমুদ্রস্নানে নিরাপত্তায় লাইফ গার্ড সংস্থার জরুরী বার্তা'
১। সৈকতে লাল হলুদ পোশাক পরিহিত সি সেফ লাইফ গার্ড সদস্যদের নির্দেশনা সর্বদা মেনে চলুন।
২। সি সেফ লাইফ গার্ড নির্দেশিত স্থান ব্যতীত অন্য কোথাও পানিতে নামবেন না।
৩। সৈকতে লাল পতাকা চিহ্নিত স্থানে কোনোভাবেই পানিতে নামবেন না।
৪। সৈকতে সব সময় লাল হলুদ পতাকার মধ্যবর্তী স্থানে পানিতে নামুন।
৫। সৈকতের নামার আগে অবশ্যই জোয়ার-ভাটাসহ আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জেনে নিন।
৬। লাইফ জ্যাকেট ছাড়া হাটু পানির বেশি গভীরে যাবেন না।
৭। সৈকতে প্রায় শিশু হারিয়ে যায় তাই আপনার শিশুকে দেখে শুনে রাখুন, নিজ তত্ত্বাবধানে রাখুন শিশুদের কখনো একা ছাড়বেন না।
৮। জেলা প্রশাসন, ট্যুরিস্ট পুলিশ, বিচ কর্মী এবং সি সেফ লাইফ গার্ড আপনাদের সার্বিক সেবায় নিয়োজিত আছে প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতা নিন।
'লাইফ গার্ড সেবার চ্যালেঞ্জসমূহ'
১। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে একটি মাত্র লাইফ গার্ড সেবা, সি সেফ লাইফ গার্ড সেবা সিআইপিআরবি নামক একটি বেসরকারি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। সি সেফ লাইফ গার্ড সেবাটি বিভিন্ন বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে পরিচালিত হওয়ায় বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছে। এটি সরকারি কোন আর্থিক সহায়তা পাই না।
২। প্রয়োজনের তুলনায় সৈকতে লাইফ গার্ড সংখ্যা খুবই কম। কেবল ৩টি পয়েন্টে মাত্র ২৭ লাইফ গার্ড দ্বারা এই সেবা পরিচালিত হচ্ছে। অথচ বর্তমানে অন্তত ১০টি পয়েন্টে নূন্যতম ১০০ জন লাইফ গার্ড রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন।
৩। সি সেফ লাইফ গার্ড সেবাটি পরিচালনার জন্য উন্নত ও অত্যাধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম যেমন জেড স্কী, বিচ বাইক, লাইফ সাপোর্ট সহ অ্যাম্বুলেন্স এবং লাইফবোট এর প্রয়োজন রয়েছে।
৪। বিশে^র দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের জরুরী স্বাস্থ্য সেবার জন্য কোন মেডিকেল সাব সেন্টার নেই। একজন পর্যটককে পানি থেকে উদ্ধারের পর হাসপাতালে নিতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় অতিবাহিত হয় যা পানিতে ডুবা ব্যক্তির জন্য খুবই বিপদজনক। তাই পর্যটকদের পানি থেকে উদ্ধারের সাথে সাথে যাতে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় সে জন্য একটি বিশেষায়িত মেডিকেল সাব সেন্টারের প্রয়োজন।
৫। হোটেল মোটেলে পর্যটকরা প্রবেশ করার পর সমুদ্রসৈকতের বিপদ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য আরও যথাযত ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই জরুরী।
৬। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি ও পানিতে ডুবে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে লাইফ গার্ডের নির্দেশ অমান্য করা, লাইফ গার্ডের টহরলত এলাকায় পানি না নামা, বিকেল ৫টার পরেও সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ভাসমান টিউব নিয়ে পানিতে অবস্থান করা।
৭। একটি মাত্র অ্যাম্বুলেন্স থাকায় পানি থেকে পর্যটকদের উদ্ধারের পর যথাসময়ে হাসপাতালে নেওয়া যায় না। বর্তমানে পর্যটকদের দ্রুত সময়ে হাসপাতালে নিতে একাধিক অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
লাইফ গার্ড সংস্থা জানিয়েছে, সমুদ্রেস্নানের সময় দুর্ঘটনা এড়িয়ে সতর্ক করণীয় যথাযথ পালনের মাধ্যমে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনাগুলো এড়ানো যেতে পারে।